দুই সিটির ফুটপাত দখল ‘ফুটপাতহীন’ এক মহানগর ঢাকা

রাজধানী ঢাকায় সড়ক আছে, ফুটপাত আছে—কিন্তু নেই হাঁটার পরিবেশ। পলিথিনের ছাউনির নিচে বসে থাকা দোকানগুলো দখল করে রেখেছে পথচারীর একমাত্র অবলম্বন। সিটি করপোরেশনের অভিযান, জরিমানা, উচ্ছেদ—সবই ক্ষণস্থায়ী। এর ফাঁকে প্রতি মাসে হকারদের কাছ থেকে ওঠে কোটি টাকার চাঁদা।

Sep 5, 2025 - 11:19
 0  2
দুই সিটির ফুটপাত দখল ‘ফুটপাতহীন’ এক মহানগর ঢাকা
ছবি, সংগৃহিত

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানী ঢাকায় সড়ক আছে, ফুটপাত আছে—কিন্তু নেই হাঁটার পরিবেশ। পলিথিনের ছাউনির নিচে বসে থাকা দোকানগুলো দখল করে রেখেছে পথচারীর একমাত্র অবলম্বন। সিটি করপোরেশনের অভিযান, জরিমানা, উচ্ছেদ—সবই ক্ষণস্থায়ী। এর ফাঁকে প্রতি মাসে হকারদের কাছ থেকে ওঠে কোটি টাকার চাঁদা।

সেগুনবাগিচা থেকে বায়তুল মোকাররম, জিরো পয়েন্ট, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাব, মিরপুর-১০ থেকে ১৪ নম্বর পর্যন্ত প্রায় সব জায়গাতেই একই দৃশ্য। কলম, খেলনা, কাপড়, ব্যাগসহ নানা পণ্য এই পথে বিক্রি হলেও পথচারীর হাঁটার কোনো জায়গা নেই।

সরেজমিনে যা দেখা গেল : বায়তুল মোকাররমের মূল ফটকের সামনের ফুটপাতে দেখা যায় ২০০টির বেশি অস্থায়ী দোকান। পাঁচ ফুটের ফুটপাতের দুই পাশে দোকান বসিয়ে মাঝখানে এক থেকে দেড় ফুট জায়গা রেখেই চলছে পথচারীদের পারাপার।

কেউ কেউ বাধ্য হয়ে সড়ক ব্যবহার করছেন, এতে যানজট তো তৈরি হচ্ছেই, দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে। গুলিস্তানের বিভিন্ন ফুটপাতের ৯৫ শতাংশই পথচারীদের চলাচলের অনুপযোগী। হকারদের দখলে থাকা এসব দোকান সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চালু থাকে। অনেক জায়গায় সড়ক পর্যন্ত দখল হয়ে গেছে।
মিরপুর ১০ থেকে ১৪ নম্বর এলাকার প্রায় এক কিলোমিটার ফুটপাত পুরোপুরি বেদখল। এক হকার বলেন, ‘আমরা চাই না জায়গা দখল করতে, কিন্তু অন্য উপায় নেই। বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে চলে যেতাম।’ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, ফুটপাতের ওপর গাছ, বিদ্যুৎ বা টেলিফোনের খুঁটি, ফুট ওভারব্রিজের সিঁড়ি, পুলিশ বক্স—সব মিলিয়ে ফুটপাত হয়ে পড়েছে অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা গড়ে তোলার নিরাপদ স্থান। মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের সামনে ফুট ওভারব্রিজের খুঁটি ও সিঁড়ি দখল করেছে পুরো ফুটপাত।
সামান্য খালি জায়গা থাকলেও তা ব্যবহারের অনুপযোগী। কারণ সেসব জায়গা মল-মূত্র ও আবর্জনায় দূষিত। নীলক্ষেত থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত অনেক ফুটপাতে মোটরসাইকেল রাখা, দোকান বসানো এবং ফুট ওভারব্রিজের নিচে অবৈধ স্থাপনা দেখা যায়। কলাবাগান শিশু পার্কের সামনে ফুটপাতের ওপর ময়লাবাহী ভ্যান, আবর্জনার স্তূপ ও ডিএসসিসির বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র পথচারীদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করছে।

পরিসংখ্যানে ভয়াবহ চিত্র : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তথ্য মতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ২৩৬টি উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে ২১৫টি মামলায় ৪৫৯ ব্যক্তিকে দণ্ডিত করা হয়েছে এবং জরিমানা আদায় হয়েছে ছয় লাখ ৫৯ হাজার ৬০০ টাকা। এ সময় ২ হাজার ১৭০টি অস্থায়ী এবং ৫২টি স্থায়ী অবকাঠামো উচ্ছেদ করে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার এলাকা দখলমুক্ত করা হয়েছে।

তবু ডিএনসিসির ২২৩ কিলোমিটার ফুটপাতের বেশির ভাগ এখনো বেদখল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার অবস্থা আরো খারাপ। গত ১২ মাসে (আগস্ট ২০২৪ থেকে আগস্ট ২০২৫) ৭০টি অভিযানে ৭৮টি মামলা দিয়ে মাত্র এক লাখ ৭৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘গুলিস্তান এলাকাতেই মোট ফুটপাতের প্রায় ৯৫% দখলে। এমনকি সড়ক পর্যন্ত দখল হয়ে যাচ্ছে।’

দখলমুক্ত হলেও পরিবর্তন আসে না : সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীর ১০৮ কিলোমিটার ফুটপাত বিভিন্ন প্রভাবশালীর দখলে। ২ হাজার ২৯০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫৭২ কিলোমিটারে চলে পণ্যের পসরা।

চাঁদার বাণিজ্য : শুধু গুলিস্তান ও আশপাশে ফুটপাত দখল করে বসা দোকান থেকে দৈনিক জনপ্রতি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়, যা মাসে দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি টাকা। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ইওএউ) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দুই সিটি করপোরেশনে বছরে প্রায় ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয় হকারদের কাছ থেকে।

কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা : উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘ফুটপাত নিয়ে আমাদের বিশেষ পরিকল্পনা আছে। আমরা দখলমুক্ত করেও দেখি, সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রাজনৈতিক এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তা ছাড়া স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।’

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গুলিস্তানে দিনে একাধিকবার অভিযান চালানো হলেও হকাররা আবার বসে যায়। অভিযানের আগেই তারা খবর পেয়ে যায়।”

এমবি এইচআর