কক্সবাজারে বন্ধ হচ্ছে লাইফগার্ড সেবা, সাগরে গোসলে নামা পর্যটকদের কী হবে

আন্তর্জাতিক (ইউকে) সংস্থা ‘রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউট’–এর (আরএনএলআই) অর্থায়নে ২০১২ সাল থেকে সি-সেফ লাইফগার্ড সৈকতে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গত ১২ বছরে সংস্থার ২৭ কর্মী ৮০৭ পর্যটককে উদ্ধার করেছেন। তহবিলের সংকটে ৩০ সেপ্টেম্বর এই সেবা বন্ধ হচ্ছে।

Sep 19, 2025 - 12:20
 0  2
কক্সবাজারে বন্ধ হচ্ছে লাইফগার্ড সেবা, সাগরে গোসলে নামা পর্যটকদের কী হবে
ছবি-সংগৃহিত

নিজস্ব প্রতিবেদক: তহবিলের সংকটের কারণে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের প্রাণ রক্ষায় নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সি-সেফ লাইফগার্ডের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে। ফলে ১ অক্টোবর থেকে সমুদ্রে গোসলে নামা পর্যটকদের ঝুঁকি বাড়বে। সাগরে নেমে স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া পর্যটকদের উদ্ধারে থাকবে না কোনো তৎপরতা। পাশাপাশি চাকরি হারাবেন ২৭ জন লাইফগার্ডসহ ৩৫ জন।

আন্তর্জাতিক (ইউকে) সংস্থা ‘রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউট’–এর (আরএনএলআই) অর্থায়নে ২০১২ সাল থেকে সি-সেফ লাইফগার্ড সৈকতে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। গত ১২ বছরে ২৭ জন লাইফগার্ড কর্মী সৈকতের কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারে স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার সময় অন্তত ৮০৭ পর্যটককে উদ্ধার করে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। একই সময় গুপ্তখাল কিংবা স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে নিহত ৬৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

সি-সেফ লাইফগার্ডের সুপারভাইজার সিফাত সাইফুল্লাহ বলেন, গত সোম ও মঙ্গলবার সৈকতের সুগন্ধা ও লাবণী পয়েন্টে ভেসে যাওয়ার সময় পাঁচজনকে উদ্ধার করে প্রাণে রক্ষা করা হয়। চলতি বছরের আট মাসে সৈকতে গোসলে নেমে মারা গেছেন ১১ জন পর্যটক। এ ছাড়া ভেসে যাওয়ার সময় উদ্ধার করা হয় আরও ১১ জনকে।

সর্বশেষ ৭ সেপ্টেম্বর বেলা তিনটায় সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্টে গোসলে নেমে নিখোঁজ হয় বগুড়ার কলেজছাত্র জুহায়ের আয়মান (১৭)। সে ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের খালাতো ভাই মো. শরিফুল ইসলামের ছেলে। পরের দিন সমিতিপাড়া সৈকতে তার লাশ ভেসে আসে।

৭ জুলাই সকাল পৌনে সাতটার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের প্যাঁচার দ্বীপের হিমছড়ির সৈকত এলাকায় সাগরে গোসলে নেমে ভেসে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী অরিত্র হাসান, কে এম সাদমান রহমান ও আসিফ আহমেদ। দুই ঘণ্টা পর হিমছড়ি সৈকতেই কে এম সাদমান রহমানের লাশ ভেসে আসে। পরদিন ৮ জুলাই সকাল ৯টার দিকে ঘটনাস্থলের প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক শুঁটকিমহাল সৈকতে পাওয়া যায় আসিফ আহমেদের লাশ; কিন্তু দুই মাসের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও অরিত্র হাসানের সন্ধান মেলেনি। সেবা কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার খবরে লাইফগার্ড কর্মীরা যেমন বিপাকে, তেমনি পর্যটকেরাও হতাশ।

সমুদ্রে কোনো পর্যটক ভেসে গেলে আমরা ঝুঁকি নিয়ে জীবন বাঁচাই, এখন আমাদের জীবনটাই ঝুঁকিতে পড়ে গেল। আমাদের বাঁচানোর কেউ নেই

মো. ওসমান, লাইফগার্ড কর্মী

হোটেলমালিকদের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিবছর কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণে আসেন অন্তত ৭০ লাখ মানুষ। পাঁচ কিলোমিটারে লাইফগার্ড সেবা থাকলেও আরও ১১৫ কিলোমিটার সৈকত অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকছে।

সি সেফ লাইফ গার্ডের সদস্যরা কক্সবাজার সৈকতের পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তায় কাজ করছেন গত এক যুগ ধরে। ৩০ সেপ্টেম্বর বন্ধ হচ্ছে তাদের কার্যক্রম
সি সেফ লাইফ গার্ডের সদস্যরা কক্সবাজার সৈকতের পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তায় কাজ করছেন গত এক যুগ ধরে। ৩০ সেপ্টেম্বর বন্ধ হচ্ছে তাদের কার্যক্রম

দরকার সরকারি উদ্যোগ

সি-সেফ লাইফগার্ড প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, তহবিলের সংকটের কারণে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সি-সেফ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের তৎপরতায় দাতা সংস্থা প্রকল্পের মেয়াদ গত জুন পর্যন্ত ছয় মাস বর্ধিত করে। এরপর দ্বিতীয় দফায় ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরও তিন মাস বাড়ানো হয়। অর্থের জোগান না হওয়ায় চলতি সেপ্টেম্বরেই লাইফগার্ড সেবা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানে ২৭ জন লাইফগার্ডসহ মোট ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিপরীতে মাসে গড়ে ১৪ লাখ টাকা জোগান দিত সংস্থাটি। বছরে লাগত দেড় কোটি টাকার মতো।

এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, তহবিলের সংকটের কারণে লাইফগার্ড সেবা এই সেপ্টেম্বরে বন্ধ হওয়ার বিষয়টি পর্যটন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা হচ্ছে, সৈকত এলাকার হোটেলগুলোর মাধ্যমে লাইফগার্ড সেবা চালু রাখতে হবে। এ বিষয়ে হোটেলমালিকদের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের বৈঠকও হয়েছে।

৭ জুলাই সকাল পৌনে সাতটার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের প্যাঁচার দ্বীপের হিমছড়ির সৈকত এলাকায় সাগরে গোসলে নেমে ভেসে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী অরিত্র হাসান, কে এম সাদমান রহমান ও আসিফ আহমেদ। দুই ঘণ্টা পর হিমছড়ি সৈকতেই কে এম সাদমান রহমানের লাশ ভেসে আসে। পরদিন ৮ জুলাই সকাল ৯টার দিকে ঘটনাস্থলের প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক শুঁটকিমহাল সৈকতে পাওয়া যায় আসিফ আহমেদের লাশ; কিন্তু দুই মাসের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও অরিত্র হাসানের সন্ধান মেলেনি।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মালিকদের বলা হয়েছে, হোটেলের অর্থায়নে লাইফগার্ড সেবা চালু রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সৈকত এলাকার বড় (তারকা) হোটেলগুলো তিনজন এবং ছোট হোটেলগুলোকে একজন করে লাইফগার্ডের বেতন পরিশোধ করতে হবে। হোটেল ব্যবস্থাপনার নীতিমালায় লাইফগার্ড পরিচালনার বিষয়টি উল্লেখ আছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে বর্তমান লাইফগার্ডদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। যেহেতু তাঁরা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কিন্তু হোটেলমালিকেরা জেলা প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ। কক্সবাজার হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, হোটেলমালিকদের ব্যবস্থাপনায় ২৭ জন লাইফগার্ড পরিচালনার নির্দেশনা পর্যটন মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া হলেও হোটেলমালিকেরা মাসে ১৪-১৫ লাখ টাকার জোগান দিতে পারবে কি না, সন্দেহ আছে। তাতে কেউ সাড়া দিচ্ছেন না। দিলেও সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে আগামী অক্টোবর মাস থেকে লাইফগার্ড সেবা চালু করা সম্ভব হবে না।

হোটেলমালিকেরা বলেন, লাইফগার্ড সেবা বন্ধ হয়ে গেলে পর্যটকেরা নিরাপত্তার হুমকিতে পড়বেন। প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে ৬০-৭০ লাখ মানুষ সৈকত ভ্রমণে আসছেন, তাতে ভাটা পড়বে। সরকারি উদ্যোগে লাইফগার্ড সেবা চালু রাখা দরকার।

ভোরে এলে সৈকতে চোখে পড়ে লাইফ গার্ডদের অনুশীলনের দৃশ্য। ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে এই দৃশ্য আর দেখা যাবে না
ভোরে এলে সৈকতে চোখে পড়ে লাইফ গার্ডদের অনুশীলনের দৃশ্য। ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে এই দৃশ্য আর দেখা যাবে না

ঝুঁকিতে পর্যটকেরা

গত বুধবার দুপুরে সৈকতে সুগন্ধা পয়েন্টে নেমে দেখা গেছে, ২০ হাজারের বেশি মানুষ সমুদ্রের পানিতে নেমে গোসল করছেন। চৌকিতে বসে, বালুচরে দাঁড়িয়ে কিংবা কোমরসমান পানিতে নেমে পর্যটকের নিরাপত্তা দিচ্ছেন কয়েকজন লাইফগার্ড। ঢেউয়ের ধাক্কায় কোনো পর্যটক টিউব থেকে ছিটকে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করে আনছেন লাইফগার্ডরা। লাইফগার্ডদের পরনে থাকে লাল-হলুদ টি–শার্ট ও প্যান্ট। মুখে বাঁশি, হাতে উদ্ধার সরঞ্জাম।

স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে সৈকতের চেয়ার-ছাতায় (কিটকট) বসে গোসলের দৃশ্য দেখছিলেন ঢাকার ডেমরা এলাকার ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন। ঢেউয়ের ধাক্কায় কেউ ভেসে যাওয়ার উপক্রম হলে তিনি চিৎকার মারেন। নাসির উদ্দিন (৫৫) বলেন, লাইফগার্ড না থাকলে কত পর্যটকের মৃত্যু হতো, তা সহজে আন্দাজ করা যায়। শোনা গেল, অক্টোবর থেকে লাইফগার্ড আর থাকছে না, তখন পর্যটকের কী হবে?

দিশাহারা লাইফগার্ড কর্মীরা

বুধবার বিকেলে সুগন্ধা পয়েন্টে বাঁশি বাজিয়ে পর্যটকদের সতর্ক করছিলেন লাইফগার্ড আকরাম ত্রিপুরা। বাড়ি বান্দরবানের লামায়। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন শহরের লাইটহাউসের ভাড়া বাসায়। ১১ বছর ধরে লাইফগার্ডের সেবা দেওয়া আকরাম ত্রিপুরা বলেন, ‘২০ হাজার টাকা দিয়ে এমনিতে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। চাকরি হারালে কীভাবে সংসার চালাব, ভেবে পাচ্ছি না।’ একই সময় ধরে লাইফগার্ডের সেবা দিচ্ছেন নাইক্ষ্যংছড়ির জয়নাল আবেদীন ও কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়ার মো. ওসমান। দুজনের পরিবারে সদস্য পাঁচ ও সাতজন।

মো. ওসমান বলেন, ‘সমুদ্রে কোনো পর্যটক ভেসে গেলে আমরা ঝুঁকি নিয়ে জীবন বাঁচাই, এখন আমাদের জীবনটাই ঝুঁকিতে পড়ে গেল। আমাদের বাঁচানোর কেউ নেই।’

জয়নাল আবেদীন বলেন, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনি একাই ৯৮ জন পর্যটকের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছেন। লাইফগার্ড ছাড়া অন্য কিছু করে সংসার চালানোর মতো কাজও এলাকায় নেই। লাইফগার্ডের প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন বেকার থাকতে হবে তাঁকে।

এমবি এইচআর