রোহিঙ্গা শিবিরে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছিলেন মাস্টার মুহিবুল্লাহ
পৃথিবীতে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা অন্যতম অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গা। জাতিসংঘের সর্বজনীন মৌলিক মানবাধিকার সনদের ২৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিটি মানুষের অধিকার হলেও বরাবরই শিক্ষাক্ষেত্রে এই মৌলিক অধিকার থেকে স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার অভাবে বঞ্চিত এই রোহিঙ্গারা।

নিজস্ব প্রতিবেদক: পৃথিবীতে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা অন্যতম অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গা। জাতিসংঘের সর্বজনীন মৌলিক মানবাধিকার সনদের ২৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিটি মানুষের অধিকার হলেও বরাবরই শিক্ষাক্ষেত্রে এই মৌলিক অধিকার থেকে স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার অভাবে বঞ্চিত এই রোহিঙ্গারা।
নিপীড়িত এই জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের মুখপাত্র হয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ ছিলেন একজন মেধাবী শিক্ষক। রোহিঙ্গাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে সোচ্চার মুহিবুল্লাহ একসময় হয়ে উঠেন নিজ জনগোষ্ঠীর আলোর পাথেয়।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমার থেকে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। মূলত ওই বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা শুরু হওয়া গণহত্যার কারণে প্রথমে প্রায় ৬ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। পরবর্তীতে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৩ লাখ ২৪ হাজারে। এর মধ্যে ছিলেন রোহিঙ্গা নেতা ও শিক্ষক মুহিবুল্লাহও। তিনিও মিয়ানমারের মংডুর সিকদার পাড়া থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
‘আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস’ (এআরএসপিএইচআর) নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে স্বদেশে ফেরার স্বপ্ন বাস্তবায়নে মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন ‘পিস ফাদার’ হিসেবে পরিচিত এই রোহিঙ্গা শিক্ষক।
মিয়ানমারের সিটওয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করা মুহিবুল্লাহ শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
১৯৭১ সালে জন্মগ্রহণ করা মুহিবুল্লাহ জীবদ্দশায় প্রায় ৩০ বছর শিক্ষকতার পাশাপাশি অসংখ্য শিক্ষক তৈরি করে নিজ জাতিগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষা প্রসারে রেখে গেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ২০১৯ সালের জুনে উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প ১-ইস্ট এ যাত্রা শুরু করে ‘কায়াপুরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ নামে আশ্রিত রোহিঙ্গা শিক্ষিত যুবক ও মধ্যবয়সীদের হাতে গড়া একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পথপ্রদর্শক হিসেবে শত সীমাবদ্ধতার পরও বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠায় মুহিবুল্লাহ ছিলেন নেপথ্য নায়ক।
অনিশ্চিত আশ্রয় জীবনের অবসান ঘটাতে ‘প্রত্যাবাসন’ চাইতে গিয়ে জনমত তৈরি করা মুহিবুল্লাহ স্বজাতির মধ্যে থাকা বিরোধীদের পথের কাঁটা হয়ে উঠেন। রোহিঙ্গা আততায়ীদের গুলিতে ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রাণ হারান তিনি।
মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে কায়াপুরীর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বার্মিজ ভাষায় ৫ মিনিটের একটি ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি, যেটি সংরক্ষণ করে রেখেছে এআরএসপিএইচআর।
শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি অনুপ্রেরণামূলক সেই ভাষণে মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠনে শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেছিলেন, তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে, কারণ শিক্ষা তাদের ক্ষমতায়নের পথ খুলে দেয় এবং উন্নয়ন ও বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে। শিক্ষা তরুণদের সমালোচনামূলক চিন্তার ক্ষমতা দেয়, যা তাদের নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম করে।
তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন, শিক্ষা হলো দারিদ্র্যের চক্র ভাঙার সবচেয়ে কার্যকর শক্তি এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভিত্তি। বিখ্যাত সেই বক্তব্যে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ‘সহযোদ্ধা’ বলে সম্বোধন করে তিনি ঐক্য ও সংহতির বার্তা দিয়েছিলেন।
তিনি রোহিঙ্গাদের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন—শিক্ষাকে জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে এগিয়ে যেতে, কারণ এটি একটি শক্তিশালী ও টেকসই সম্প্রদায় গঠনের অপরিহার্য উপাদান।
কায়াপুরি বিদ্যালয় বর্তমান শিক্ষার্থী হাজার ছাড়িয়েছে, ক্যাম্পগুলোতে বেড়েছে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমের পরিধি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন মোহাম্মদ শোয়াইফ যিনি সম্প্রতি ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ভোটে রোহিঙ্গা কমিউনিটি প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।
মুহিবুল্লাহর স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে মোহাম্মদ শোয়াইফ বলেন, রোহিঙ্গাদের মাঝে শিক্ষা প্রসারে মাস্টার মুহিব্বুল্লাহ সাহেবের ভূমিকা কখনোই ভুলে যাওয়ার মতো নয়, আজকের কায়াপুরী তারই প্রতিফলন। তিনি আমাদের কারিকুলাম ডেভলাপ (পাঠ্যক্রম উন্নয়ন) করেছেন, সবসময় আমাদের পরামর্শ দিতেন এবং ছিলেন ছায়া হয়ে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মুহিবুল্লাহর ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়, সেখানে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে আসা নানা বয়সী রোহিঙ্গারা তার অবদানের কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
৪নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বৃদ্ধ মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ (৬৫) বলেন, মুহিবুল্লাহ বয়সে আমার ছোট হলেও ছিলেন শ্রদ্ধার মানুষ। তিনি আমাদের নিয়ে আলোচনা করতেন, ছেলে-মেয়ের শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে তাদের পাঠদানে উদ্ধুদ্ধ করতেন।
রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা মাস্টার সৈয়দউল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাস্টার মহিবুল্লাহ আমাদের ঘরে ফেরার স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন। আমরা সে পথে এগোচ্ছি, বাংলাদেশ আমাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে কিন্তু আমরা এখানে তো চিরকাল থাকব না। একদিন মাতৃভূমি আরাকানে ফিরব আশা করি হয়তো সে সময় বেশি দূর নয়।
মুহিবুল্লাহর মৃত্যুর এক দিন পর ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে তার ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ২০২২ সালের ১২ জুন কক্সবাজারের একটি আদালতে আলোচিত এই মামলায় ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ, মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন।
রোহিঙ্গা নেতারাসহ মুহিবুল্লাহর পরিবারের সদস্যরা হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ বিচার প্রত্যাশা করেছেন। স্ত্রী, সন্তানসহ মুহিবুল্লাহর পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সহায়তায় কানাডায় 'রিস্যাটেল্ড' হয়ে সেখানে বাস করছেন।
সম্প্রতি মুঠোফোনে প্রতিবেদকের সঙ্গে কানাডায় বসবাসরত মুহিবুল্লাহর ছেলে হাশমেদ উল্লাহর আলাপ হয়। তিনি বলেন, আমরা ভালো আছি। কিন্তু বাবা হারানোর ক্ষতি অপূরণীয়। বাংলাদেশ আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছে, আমার পরিবার কৃতজ্ঞ। বাবার স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে, সে লক্ষে তার সংগঠন এআরএসপিএইচআর কাজ করে যাচ্ছে। আমরা আশা করি, আইনি প্রক্রিয়ায় আমার বাবার হত্যাকারীরা শাস্তি পাবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের মার্চে জেনেভা ও জুলাইয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে সফর করেছিলেন মুহিবুল্লাহ। যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর কাড়েন। এ ছাড়া, একই বছরের ২৫ আগস্ট উখিয়ার কুতুপালংয়ে দ্বিতীয় রোহিঙ্গা গণহত্যা স্মরণ দিবস উপলক্ষে প্রত্যাবাসনের দাবিতে মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় বৃহৎ সমাবেশ যেখানে অংশ নেয় প্রায় ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা।
এমবি এইচআর