পোষা প্রাণী ঘরে থাকলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কি বাড়ে?

পোষা প্রাণীর উপস্থিতি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এটা অ্যালার্জি, একজিমা বা চুলকানি এবং থাইরয়েড সংক্রান্ত রোগ, টাইপ ওয়ান ডায়বেটিসের মতো অটোইমিউনো ডিজিজের ঝুঁকিও কমিয়ে দিতে পারে বলে দাবি করছেন গবেষকরা। 

Oct 4, 2025 - 16:54
 0  2
পোষা প্রাণী ঘরে থাকলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কি বাড়ে?
ছবি, সংগৃহিত

নিজস্ব প্রতিবেদক: পোষা প্রাণীর উপস্থিতি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এটা অ্যালার্জি, একজিমা বা চুলকানি এবং থাইরয়েড সংক্রান্ত রোগ, টাইপ ওয়ান ডায়বেটিসের মতো অটোইমিউনো ডিজিজের ঝুঁকিও কমিয়ে দিতে পারে বলে দাবি করছেন গবেষকরা। 

এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে আমিশ সম্প্রদায়ের মতো সম্প্রদায়ের কথাও উল্লেখ করা দরকার। অষ্টাদশ শতকে মধ্য ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকায় চলে আসা আমিশরা তাদের অনন্য জীবনযাত্রার জন্য আজও পরিচিত। এই স্পম্প্রদায়ের মানুষ ঐতিহ্যবাহীভাবে সাদামাটা জীবন যাপন করেন।

তারা দুধ উৎপাদনের জন্য গবাদি পশুর লালন-পালন করেন, ঘোড়ায় টানা গাড়ি ব্যবহার করেন- ঠিক যেমনটা বহু শতাব্দী ধরে তাদের পূর্বপুরুষরা করে এসেছে। পরিবার এবং কমিউনিটিকে প্রাধান্য দিতে তারা আধুনিক প্রযুক্তির দিকে তেমন মনোনিবেশ না করে পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রাকেই অনুসরণ করেন।

তাদের জীবনযাত্রা অনেকের নজর কেড়েছে। গত কয়েক দশক ধরে হলিউডের চিত্রনাট্যকার, ডকুমেন্টারি নির্মাতা এবং সমাজবিজ্ঞানীদের কল্পনাকে উসকে দিয়েছে তাদের জীবনধারণের এই পথ।

গত দশ বছরে চিকিৎসা জগতের কাছেও তাদের এই জীবনযাত্রা আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। কারণ, আধুনিক সময়ের একটা প্রবণতাকে এড়িয়ে যেতে পেরেছে তারা। ১৯৬০ এর দশক থেকে হাঁপানি, একজিমা এবং অ্যালার্জির মতো প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত রোগের বাড়বাড়ন্ত লক্ষ্য করা গেলেও তা কিন্তু আমিশদের প্রভাবিত করতে পারেনি।

এর নেপথ্যে থাকা কারণ একদিকে যেমন মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে তার বিষয়ে যেমন আভাস দেয়, তেমনই প্রাণীর উপস্থিতি ওই প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে সেটাও তুলে ধরে।

অনন্য সম্প্রদায়
আমিশ সম্প্রদায়ের মধ্যে কয়েকটা রোগের প্রকোপ কেন কম দেখা যায়। তা জানার জন্য ২০১২ সালে একদল গবেষক ইন্ডিয়ানায় বসবাসকারী আমিশ সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করেছিলেন। একইভাবে তারা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সাউথ ডাকোটায় হুটেরাইটস বা হুটেরিয়ান নামে পরিচিত আরেক সম্প্রদায়ের মানুষকেও। দুই ক্ষেত্রেই গবেষকরা ৩০জন শিশুর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন।

হুটেরাইটস কৃষিভিত্তিক সম্প্রদায় এবং তারাও আমিশদের মতোই নিজেদের কমিউনিটির মাঝে থাকতে পছন্দ করে। আমিশ এবং হুটেরাইটসদের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। তাদের পূর্বপুরুষরা ইউরোপীয়, দুই সম্প্রদায়ের মানুষই দুষিত বায়ুর সংস্পর্শে কম এসেছেন এবং তারা প্রক্রিয়াজাত খাবার কম খান।

তবে হুটেরাইটস সম্প্রদায়ের শিশুদের মধ্যে হাঁপানি এবং শৈশবকালীন অ্যালার্জির হার আমিশ সম্প্রদায়ের শিশুদের তুলনায় চার থেকে ছয়গুণ বেশি।

গবেষকরা এর কারণ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন। তাদের মতে, এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা পার্থক্য হলো হুটেরাইটসরা শিল্পায়িত কৃষি প্রযুক্তিগুলোকে পুরোপুরি গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমিশ সম্প্রদায় তা করেনি।

এর অর্থ হলো অল্প বয়স থেকেই আমিশ সম্প্রদায়ের মানুষ প্রাণীদের সাহচর্যে রয়েছে এবং তাদের (ওই প্রাণীদের) বয়ে আনা করা জীবাণুর সংস্পর্শেও থেকেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানির একদল গবেষক এই নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে আমিশ সম্প্রদায়ের শিশুদের মধ্যে অ্যালার্জির ঝুঁকি কম থাকার কারণ, পরিবেশ তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এইভাবে গড়ে তুলেছে।

তাদের ওই গবেষণা ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় এবং একে যুগান্তকারী গবেষণা বলে মনে করা হয়। ওই গবেষকরা লক্ষ্য করেন, হুটেরাইট সম্প্রদায়ের শিশুদের তুলনায় আমিশ শিশুদের শরীরে 'টি কোষগুলো' আরও বেশি কার্যকর। এই 'টি কোষ'ই মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

দুই সম্প্রদায়ের শিশুদের বাড়ি থেকে ধুলোবালির নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন গবেষকরা। উদ্দেশ্য ছিল, ওই ধূলিকণায় কী কী ধরনের ব্যাকটেরিয়া রয়েছে তা খতিয়ে দেখা। সেই সময় স্পষ্ট প্রমাণ মেলে যে আমিশ স্পম্প্রদায়ের শিশুরা আরও বেশি পরিমাণে মাইক্রোবের (অণুজীব বা জীবাণু) সংস্পর্শে এসেছে এবং সেটা সম্ভবত সেই প্রাণীদের থেকে আসা যাদের সাহচর্যে তারা বাস করে।

গবেষকদের মতে, সাত থেকে নয় বছর বয়সের শিশুর অ্যালার্জির ঝুঁকি তাদের জীবনের প্রথম বছরগুলোতে বাড়িতে উপস্থিত পোষা প্রাণীর সংখ্যার সাথে আনুপাতিকভাবে হ্রাস পায়। একে 'মিনি-ফার্ম এফেক্ট' বলা হয়।

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, সান দিয়েগোর অধ্যাপক জ্যাক গিলবার্ট আমিশ সম্প্রদায়ের ওপর চালানো ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার কথায়, "এটা কোনো সার্বজনীন নিরাময় নয়। যখনই আমি এই বিষয় নিয়ে কোথাও বিষয়ে বক্তৃতা দিই, কেউ না কেউ বলে ওঠে- আমি খামারে বড় হয়েছি, আমার অ্যালার্জি হয়েছে।"

"কিন্তু আমরা দেখেছি, আপনি যদি খামারের প্রাণীদের সঙ্গে মেলামেশা করে বেড়ে ওঠেন, তাহলে আপনার অ্যাজমা বা অ্যালার্জি হওয়ার শঙ্কা প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায়। এমন কি আপনি যদি একটা কুকুরের সঙ্গে বড় হন তাহলে বা অ্যালার্জির ঝুঁকি ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ কমে যায়।"

চলতি বছরের সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটা নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, জিনগতভাবে একজিমার প্রবণতা রয়েছে এমন শিশুর বাড়িতে কুকুর পোষা হলে তা ওই রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।

প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা
আমিশ সম্প্রদায়ের রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার পর শৈশবে প্রাণীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সম্ভাব্য প্রভাব অনেকের কাছেই আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি পোষা প্রাণী নতুন "প্রোবায়োটিক" (উপকারী ব্যাকরেটিয়ার মতো কাজ করে) কি না- এই প্রশ্ন তুলে নিউ ইয়র্ক টাইমস নিবন্ধও প্রকাশ করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিষয়ক অধ্যাপক নাসিয়া সাফদারের মতে, পোষা প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের রোগ প্রতিরোধের সম্পর্কের ধারণা পেট ফুড ইন্ডাস্ট্রির (যারা প্রাণীদের জন্য খাবার প্রস্তুত করে) আগ্রহ জাগাতে পারে।

কুকুর ও বিড়ালের মধ্যে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বাড়াতে পারে এমন খাবারকে বাজারজাত পণ্য হিসেবে তৈরি করা এবং তার প্রচার করার কথা ভাবতে পারে পেট ফুড ইন্ডাস্ট্রি। পোষা প্রাণীর দেহে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়া যাতে পোষ্যের মালিকের দেহে স্থানান্তরিত হতে পারে সেই ভাবনার ওপর জোর দিতে পারে তারা।

অধ্যাপক সাফদার বলেছেন, "এই দৃষ্টিভঙ্গিটা ফান্ডিংয়ের দিক থেকে অনেকের নজর কেড়েছে, কারণ আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই মানুষের শারীরিক অবস্থার বিষয় নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে।"

"তাহলে এতে প্রাণীর কী ভূমিকা থাকতে পারে?" এই বিষয়ে তিনি একটা পরীক্ষা চালানোর কথা ভাবছেন, যেখানে পোষা প্রাণী এবং তাদের মালিক যখন একাধিকবার পশুচিকিৎসকের কাছে আসবেন, তখন তাদের দুজনেরই মলের নমুনা সংগ্রহ করা হবে। তারপর পরীক্ষা করে দেখতে হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের দু'জনের অন্ত্রে উপস্থিত মাইক্রোবায়োমের মধ্যে মিল পাওয়া যায় কি না।দু'জনের শরীরে একই ধরনের ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতি শনাক্ত করা যায় কি না, যাতে স্বাস্থ্যগত সুবিধা মিলতে পারে।

অধ্যাপক গিলবার্ট একটা অন্য তত্ত্ব উল্লেখ করেছেন। তার তত্ত্ব হলো- যেহেতু আমাদের পূর্বপুরুষরা বিভিন্ন প্রজাতির পশুকে পালন করতো তাই আমাদের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা প্রাণীদের বয়ে আনা বহন মাইক্রোব দ্বারা উদ্দীপিত হওয়ার জন্য বিকশিত হয়েছে। তবে এই মাইক্রোব স্থায়ীভাবে মানবশরীরে থাকে না।

কিন্তু আমাদের প্রতিরোধক কোষগুলো ওই পরিচিত সংকেতকে শনাক্ত করতে পারে যা পরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বিকাশে সাহায্য করে।

তিনি বলেন, "বহু সহস্রাব্দ ধরে মানুষের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা কুকুর, ঘোড়া ও গরুর ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আর তাই তারা যখন সেই একই জিনিস শনাক্ত করে, তখন তা উপকারী প্রতিরোধক ক্ষমতার বিকাশকে উদ্দীপিত করে তোলে। তারা (ইমিউন সিস্টেম) বুঝতে পারে কী করতে হবে।"

গবেষণায় আরও দেখা গিয়েছে যে পরিবারে পোষ্য প্রাণী রয়েছে সেখানকার বাসিন্দাদের অন্ত্রে উপস্থিত মাইক্রোবায়োমের মধ্যে মিল রয়েছে।

অধ্যাপক গিলবার্ট ব্যাখ্যা করেছেন, ওই প্রাণী সম্ভবত তার মালিকদের মধ্যে 'হিউম্যান মাইক্রোব' স্থানান্তর করার বিষয়ে বাহকের কাজ করেছে। একইসঙ্গে, পোষা প্রাণীর নিজেদের মাইক্রোবায়মের নিয়মিত সংস্পর্শ তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আরও সক্রিয় করে তোলে। পাশাপাশি, অন্ত্রে এবং ত্বকে মাইক্রোবায়োমকে আরও ভালোভাবে পরিচালনা করতে, সংক্রামক জীবাণু রুখতে এবং উপকারী ব্যাকটিরিয়াকেও উদ্দীপিত করে।

এমবি এইচআর