রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় দেশজুড়ে সক্রিয় দুই শতাধিক কিশোর গ্যাং, লাগাম টানবে কে?

নিজস্ব প্রতিবেদক: পাড়া কিংবা মহল্লায় সর্বত্র প্রকাশ্যে দেশি অস্ত্র হাতে মহড়া, হামলা-মারধর, চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। নিজ এলাকায় প্রভাব বাড়াতে একদল আরেক দলের সঙ্গে ভয়ংকর সংঘাতেও লিপ্ত হচ্ছে। তাদের অপরাধ ঠেকাতে রীতিমতো নাজেহাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানীর উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকায় গড়ে তুলে আব্বা বাহিনী, বাবা বাহিনী, সাদা বাহিনী, কালা বাহিনী, ককটেল বাহিনী, কাটা বাহিনী, ধাওয়া বাহিনীসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম ধারণ করে ভীতি দেখায় এর সদস্যরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিঠে বড় ভাইয়ের হাত, বয়স ১৩ থেকে ২২। আছে রাজনৈতিক পরিচয়। হাতে দেশি-বিদেশি অস্ত্র। চটকদার নামে রাজধানীর গলি থেকে পাড়া-মহল্লায় গজিয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। গ্যাং সদস্যদের নাম মুখে নিতে ভীত স্কুলশিক্ষার্থীরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, দেশে কিশোর গ্যাংয়ের ২৩৭টি দল চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৪টি ঢাকা ও চট্টগ্রামে। এই গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় আনা গেলে অপরাধ দমন সম্ভব বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
রাজধানীতে আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠা কিশোর গ্যাং সদস্যরা নগরজুড়ে বেপরোয়া। দিন দিন গ্যাংয়ের সদস্যদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। পুলিশের ভাষ্য, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরাসহ অনেক এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের পৃথক গ্রুপ রয়েছে। এগুলো ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। তাদের গ্রেপ্তার করলেও জামিনে বেরিয়ে নতুন রূপে অপরাধে জড়াচ্ছে।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্সের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা দেখেছি, ৫ আগস্টের পর কিশোর গ্যাংয়ের নামে, বিশেষ করে মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আভিযানিক কার্যক্রম জোরদার করি এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় ব্যাপক ধরপাকড়ের মাধ্যমে এই সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে কিশোর গ্যাংয়ের উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা নেই। যদি কোনো সদস্য এই গ্যাংয়ের পরিচয়ে গ্যাং কালচার সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসতে তৎপর। বর্তমানে পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে এবং গ্রেপ্তার ব্যক্তি যেন বের হয়ে আবার অপরাধে না জড়াতে পারে, সেই লক্ষ্যে আমাদের নজরদারি রয়েছে। এ ছাড়া অনেকে কিশোর গ্যাংয়ের নামে তাদের লক্ষ্য হাসিলের চেষ্টা চালাতে না পরে, সেই ব্যাপারে আমরা তৎপর।’
মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ জানায়, পূর্বশত্রুতার জেরে গত ১৬ জুলাই রাতে চাঁদ উদ্যানের ৬ নম্বর রোডে আল-আমিন নামের একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহতের স্বজন ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, নিহত আল-আমিন পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। পাতা আল-আমিন পুলিশের কাছে ফর্মা আল-আমিন হিসেবে পরিচিত। এ ঘটনায় কিশোর অপরাধীসহ আরও যারা জড়িত, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের ছিনতাইয়ের ঘটনার কয়েক দিন আগে কিশোর গ্যাং লিডার ও মাদক ব্যবসায়ী মোশারফের ছোট ভাই মান্নানকে পুলিশে ধরিয়ে দেন আল-আমিন। এর জেরে মোশারফ, গিট্টুসহ কয়েকজন কিশোর গ্যাং সদস্য রাত ৯টার দিকে চাঁদ উদ্যানের ৬ নম্বর রোডে আল-আমিনকে কুপিয়ে হত্যা করে।
নিহত আল-আমিনের বাবা মো. রিপন বলেন, পরিবার নিয়ে বর্তমানে মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যানের ৫ নম্বর রোডে থাকেন। তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার হাঁটুলিয়া বাগানবাড়ি এলাকায়। আল-আমিন পাঁচ বছরের একটি ছেলেসন্তানের জনক ছিলেন।
এদিকে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে বাঁধ ভাঙা উল্লাসে ফরিদপুরের কুমার নদে ‘ডেঞ্জার গ্যাং’-এর সদস্যরা। ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার সাহসই বলে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কতটুকু ভয় পায় গ্যাংয়ের সদস্যরা। গানের তালে তালে একাধিক স্পিডবোটের ওপরে তারা চায়নিজ কুড়াল, রামদা উঁচিয়ে ধরে রেখে মহড়া দেয়। সড়কে দ্রুতবেগের মোটরসাইকেলের মতোই নদীর বুকে এঁকেবেঁকে স্পিডবোট চালিয়ে তাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে। মাদারীপুর থেকে স্পিডবোটে এসে ফরিদপুরের কুমার নদে দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের একটি গ্রুপ। এ সময় ফিল্মি স্টাইলে সাতটি স্পিডবোট নিয়ে মহড়া দেয় তারা।
ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন সত্যতা স্বীকার করে বলেন, পাশের জেলা মাদারীপুর থেকে স্পিডবোটে চড়ে এসে দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা কুমার নদে এ মহড়া দেয়। বিষয়টি জানার পর রাজৈর থানায় জানানো হয়েছে। তাদের আটকের জোর চেষ্টা চলছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন রাত আটটার দিকে নবোদয় হাউজিং এলাকার কামাল ক্যাটারিংয়ের পাশে নিজের ডিস ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে ছিলেন ইব্রাহিম। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে করে অজ্ঞাতপরিচয় তিন ব্যক্তি সেখানে গিয়ে তাকে গুলি করে। পরে স্থানীয়রা ধাওয়া দিয়ে দুজনকে আটক করে গণধোলাই দেয়। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে দুজনকে আটক করে হেফাজতে নেয়। আটক দুই ব্যক্তির নাম সজীব (৩২) ও রুবেল (৩৫) বলে জানা যায়। হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রটিও গুলিভর্তি ম্যাগজিনসহ উদ্ধার করা হয়েছে।
রাজধানীর স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ। এ তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ২১ আগস্ট ঢাকা কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
পরে সিটি কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক কাজী নিয়ামুল হক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেছিলেন, ‘তৃতীয় পক্ষ এ ঝামেলায় কাজ করে কি না, সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি। স্থানীয় কিছু কিশোর গ্যাংয়ের বখাটে ছেলে এটা করে থাকতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থা চাইলে বের করতে পারে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সেটা আমরা দেখছি না।’
ঢাকা সিটি কলেজ শিক্ষার্থী ইফতি হাসান বলেন, ‘প্রায় সময় ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজ সংঘর্ষে জড়ায়। এখানে গ্যাং কালচার তৈরি হয় কলেজের নামকে সামনে রেখে। কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কটূক্তি নিয়েই যত দ্বন্দের সূত্রপাত। প্রতিবছরই এটা হয়। এর কোনো আলাদা কারণ থাকে না। ধরেন, কোনো এক কলেজের কেউ এসে অপর ইনস্টিটিউশন নিয়ে কিছু একটা বলল, এটা নিয়ে গায়ে লাগে তারপরই লেগে যায় দ্বন্দ্ব।’
উত্তরার একাধিক অভিভাবক জানান, কখনো গলিকেন্দ্রিক বা কখনো এলাকাকেন্দ্রিক উত্তরায় ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছে কিশোর গ্যাং। একসময় নিজেদের নামের জানান দিতে দেয়ালগুলোয় নিজেদের নাম লিখে রাখা হতো। এখন সেই নাম লেখার পদ্ধতি এবং প্রচারণার পদ্ধতি চলে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
তারা আরও জানান, বিচ্ছু বাহিনী, সাইফুল গ্যাং, বাবু রাজন গ্যাংয়ের দাপটে ভীত স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। তাদের কাছে সব সময় থাকে দেশি অস্ত্র। আধিপত্য বিস্তার, পাড়ার নিয়ন্ত্রণ ও স্কুল মোড়ে দায়ী ছোট বাচ্চাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে জিম্মি করেই যেন তাদের কাজ।
এমবি/এসআর