বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো দুই পরিবারকে ৪ সপ্তাহের মধ্যে ফেরত নিতে হবে: কলকাতা হাইকোর্ট
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের পরিযায়ী দুই শ্রমিক পরিবারকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ খারিজ করে দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্ট। গতকাল শুক্রবার আদালত এক আদেশে বলেছেন, ‘খুব তাড়াহুড়া করে তাঁদের ভারত থেকে বিতাড়ন করা এই প্রক্রিয়ার স্পষ্ট লঙ্ঘন।

নিজস্ব প্রতিবেদক: ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের পরিযায়ী দুই শ্রমিক পরিবারকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ খারিজ করে দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্ট। গতকাল শুক্রবার আদালত এক আদেশে বলেছেন, ‘খুব তাড়াহুড়া করে তাঁদের ভারত থেকে বিতাড়ন করা এই প্রক্রিয়ার স্পষ্ট লঙ্ঘন। এই কর্মকাণ্ড বিতাড়নের সরকারি আদেশকে আইনি ভুল প্রমাণ করে এবং এটি বাতিলযোগ্য।’
চলতি বছরের শুরুর দিকে এই দুই মুসলিম পরিবারকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে।
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তপব্রত চক্রবর্তী ও বিচারপতি ঋতব্রত কুমার মিত্রের একটি ডিভিশন বেঞ্চ শুক্রবার নির্দেশ দিয়েছেন, আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা সোনালি খাতুনসহ (বিবি) দুই পরিবারের ছয় সদস্যকে চার সপ্তাহের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে আনতে হবে। আদালত এই আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের করা আবেদনও খারিজ করে দিয়েছেন।
আদেশে বলা হয়েছে, ‘নাগরিকত্বের প্রশ্নটি আরও নথিপত্র এবং প্রমাণের ভিত্তিতে উপযুক্ত একটি আদালতে বিবেচনা করা উচিত। বিতাড়নের ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়া এবং পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, তা এই সন্দেহ তৈরি করেছে যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত তাড়াহুড়া করে কাজ করতে গিয়ে ২ মে ২০২৫–এর মেমোর বিধিবিধান সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করেছে।’
হাইকোর্টের বেঞ্চ মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা ওই সব ব্যক্তিকে ভারতে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছি। তাঁদের ফিরিয়ে আনার জন্য কী পদক্ষেপ নিতে হবে, তা আমরা বলে দিয়েছি। সরকারকে চার সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে।’
কলকাতা হাইকোর্টের বেঞ্চ আটক ব্যক্তিদের বাংলাদেশি নাগরিকের তকমা দেওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনাও করেছেন। আগের এক শুনানিতে আদালত কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি হলফনামা দাখিল করে জানাতে বলেছিলেন, পরিবারগুলোকে কীভাবে এবং কোন জায়গা থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে। এরপর কেন্দ্রীয় সরকার সেই হলফনামা জমা দিয়েছিল।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেসদলীয় সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলাম হাইকের্টের এই আদেশকে স্বাগত জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়েছেন। এতে তিনি লিখেছেন, ‘সত্যমেব জয়তে। সত্যের জয় হয়। আজ (শুক্রবার) কলকাতা হাইকোর্ট বিজেপির নাটক ফাঁস করে দিয়েছেন। বীরভূমের অন্তঃসত্ত্বা বাসিন্দা সোনালি খাতুন (বিবি) এবং শিশুসহ পাঁচজনকে তাদের ‘বাংলাদেশি নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।’
সামিরুল আরও লিখেছেন, ‘আমি কখনো ভুলব না, বীরভূমের এই সত্যিকারের সন্তানদের পাশে যখন আমি দাঁড়িয়েছিলাম, কীভাবে বিজেপি আমার ও আমার পরিবারের ওপর জঘন্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছিল। এটা শুধু আমার জয় নয়; এটা বাংলার জয়। বিজেপির বাঙালিবিরোধী, গরিববিরোধী নীতির বিরুদ্ধে উচিত এক জবাব। (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের) নেতৃত্বে এই বিষাক্ত ও জনবিরোধী শক্তিগুলোকে গণতান্ত্রিকভাবে অপসারণ না করা পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।’
স্বজনদের মতে, সোনালি বিবি, তাঁর স্বামী দানিশ শেখ এবং তাদের আট বছরের সন্তানসহ ছয়জনকে গত জুন মাসে দিল্লি থেকে আটক করা হয়েছিল। অভিযোগ ওঠে, তাঁদের সীমান্তের ওপারে ঠেলে পাঠানো হয়েছিল। পরে তাঁর বাবা ভোদু শেখ সোনালির অনাগত সন্তানের নাগরিকত্ব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁদের ফিরিয়ে আনতে কলকাতা হাইকোর্টে একটি হেবিয়াস কর্পাস (বন্দীকে আদালতে হাজির করা) আবেদন করেন।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূমের ধিতোরা গ্রামের আরেকটি পরিবারের সদস্য সুইটি বিবি (৩২) এবং তাঁর ছয় ও ১৬ বছর বয়সী দুই ছেলেকেও প্রায় একই সময়ে আটক করে ভারত থেকে বিতাড়ন করা হয়। তাঁর আত্মীয়রাও একটি হেবিয়াস কর্পাস আবেদন করেন।
দিল্লি পুলিশ ইতিমধ্যে জানিয়েছিল, ‘বাংলাদেশি নাগরিক’ অভিযোগে বিতাড়ন করার আগে দুই পরিবারের সদস্যদের দিল্লির কে এন কাটজু মার্গ থানায় আটক রাখা হয়েছিল।
এর আগে একইভাবে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, দিল্লি ও মধ্যপ্রদেশে একই ধরনের বিতাড়নের ঘটনা ঘটেছে। গত ১৪ জুন পশ্চিমবঙ্গের সাত নাগরিককে মুম্বাই পুলিশ আটক করে এবং বিএসএফ তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠায় বলে অভিযোগ উঠেছিল।
পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের হস্তক্ষেপের পর মুর্শিদাবাদের চার তরুণ, পূর্ব বর্ধমানের একজন এবং উত্তর ২৪ পরগনার এক দম্পতিকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। তাঁরা বর্তমানে নিজেদের বাড়িতে রয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের মালদার কালিয়াচকের বাসিন্দা ১৯ বছর বয়সী আমির শেখ কয়েক মাস আগে কাজের সন্ধানে রাজস্থান রাজ্যে গিয়েছিলেন। গত জুন মাসে রাজ্য পুলিশ তাঁকে বেআইনিভাবে আটক করে। পরে আমিরকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
গত আগস্ট মাসে আমিরকে ভারতে ফিরিয়ে আনা হয়। আমিরের বাবা জিয়েম শেখ তাঁর ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য কলকাতা হাইকোর্টে বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপ চেয়ে মামলা করার পর তাঁর ছেলেকে ফিরিয়ে আনা হয়।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মিরপুর এলাকার একটি বাসা থেকে আটক করা হয় আরেক ভারতীয় নাগরিক সাকিনা বেগমকে। তাঁকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছিল। গতকালই পুলিশ সাকিনাকে আদালতে হাজির করলে বিচারক তাঁকে গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কারাগারে পাঠান। অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়েছে।
এমবি এইচআর