ঢাকা কলেজে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংঘর্ষ থেকে শুরু, দেশের সব সরকারি কলেজে কর্মবিরতি ঘোষণা

মেঘনাবার্তা: ঢাকা কলেজে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতি এবং ধাক্কাধাক্কির ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সব সরকারি কলেজে। ঘটনাটি ঘটেছে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি আইন–২০২৫’ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে পদযাত্রার সময়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, সোমবার (১৩ অক্টোবর) সাত কলেজের স্নাতক শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে পদযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি টের পেয়ে তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় পাল্টাপাল্টি উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের একপর্যায়ে স্নাতক শিক্ষার্থী ফরহাদ রেজা শিক্ষকদের লক্ষ্য করে ‘দালাল’ মন্তব্য করেন। উপস্থিত শিক্ষকরা তাকে আটক করে টিচার্স লাউঞ্জের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় শিক্ষার্থীরা বাধা দিলে ধস্তাধস্তি ও টিচার্স লাউঞ্জে কাঁচ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
ঢাকা কলেজের একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষক বলেন,“আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কিছু শিক্ষার্থী আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করায় উত্তেজনা বাড়ে। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।”
অন্য একজন শিক্ষক জানান,“সব বিষয় সংলাপের মাধ্যমে সমাধান হোক—এটাই ছিল শিক্ষকদের চাওয়া। কাউকে হেয় বা অপমান করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সেসব হলো না।”
শিক্ষার্থী ফরহাদ রেজার বক্তব্য:
ফরহাদ রেজা অভিযোগ করেছেন, “আমি কোনো শিক্ষককে আঘাত দিইনি বা শারীরিকভাবে স্পর্শও করিনি। আমাদের কর্মসূচির বিষয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা চলছিল। কিন্তু কিছু শিক্ষক এসে উল্টো আমাদের দোষ দিতে থাকেন। ১০–১৫ জন শিক্ষক আমাকে ঘিরে ধরে টানাটানি ও ধাক্কাধাক্কি করেন, এতে দুবার পড়ে যাই, হাতে ও মাথায় আঘাত পাই।”
তিনি আরও বলেন,“আমার জুতা, ঘড়ি ও কাপড় ছিঁড়ে যায় এবং মাথা ফেটে রক্তও বের হয়। পরে আমাকে অফিসে নিয়ে গিয়ে জোর করে লিখিত বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়।”
শিক্ষক সংগঠনের প্রতিক্রিয়া:
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহাবস্থান, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌহার্দ্য রক্ষাই আমাদের মূল লক্ষ্য। সাম্প্রতিক ঘটনাটি সেই মূল্যবোধকে আঘাত করেছে। আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা চাই।”
শিক্ষকরা একই সঙ্গে দেশের সব সরকারি কলেজে কর্মবিরতি ও কালো ব্যাজ ধারণের ঘোষণা দিয়েছেন। এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব ড. মো. মাসুদ রানা খান বলেন, “সব শিক্ষককে শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদ জানাতে এবং কর্মবিরতির মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান প্রদর্শনের আহ্বান জানাচ্ছি।”
শিক্ষার্থীদের অবস্থান:
উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অধ্যাদেশ সংশোধনের দাবিতে রাজপথে অবস্থান ও অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে স্নাতক শিক্ষার্থীরা ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি আইন–২০২৫’ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে একটিত। এই উত্তেজনার ফলে সাত কলেজের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
সাত কলেজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যাপক মাহফিল আরা বেগম বলেন, “উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারের দিকে পদযাত্রার আয়োজন করেছে। পাশাপাশি স্নাতক শিক্ষার্থীরা অধ্যাদেশ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে একত্রিত হয়েছে। শিক্ষকদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সংলাপের মধ্যেও উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।”
সরকারি পদক্ষেপ:
সরকারি সাত কলেজকে পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের অধ্যাদেশ প্রণয়নের প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ। শিক্ষার্থী প্রতিনিধি তানজিমুল আজিজ জানিয়েছেন, “আগামী তিন থেকে চার দিনের মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে পরামর্শ শেষ করার পর অধ্যাদেশ জারি করা হবে। অধ্যাদেশের চূড়ান্তকরণের ধাপগুলো সুস্পষ্ট।”
উদ্যোগ গ্রহণকারী কর্মকর্তা আরও জানান, প্রায় ছয় হাজার মতামত যাচাই-বাছাই ও নথিভুক্ত করা হয়েছে। এখন পাঁচজন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং শিগগিরই সব স্টেকহোল্ডারকে ডাকা হবে।
ঢাকা কলেজে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংঘর্ষ এবং সাত কলেজকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা অধ্যাদেশ সংশোধনের দাবি জানাচ্ছেন, শিক্ষকরা অভিযোগ করছেন শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের নামে শৃঙ্খলাভঙ্গ ও অসম্মান করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে অধ্যাদেশ চূড়ান্তকরণের জন্য কার্যক্রম চলমান, তবে এখনও কোনো অফিসিয়াল মন্তব্য পাওয়া যায়নি ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ও ইউজিসি সদস্যদের পক্ষ থেকে।
এমবি/এসআর