জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ডিসেম্বরে সহিংসতার শঙ্কা, দুশ্চিন্তার কারণ পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক: নির্বাচন ঘিরে ইতিমধ্যে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন কমিশন অফিসেও নানা কর্মযজ্ঞ চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। প্রস্তুত করা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। কেনা হচ্ছে কিছু সরঞ্জামাদিও। তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, তফসিল ঘোষণার আগে-পরে দেশজুড়ে নানা সহিংসতা ঘটতে পারে। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হতে পারে। সূত্র আরও বলছে, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র নিয়ে বড় শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অপরাধ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট সারা দেশের অন্তত ৪০০ থানা ও পুলিশ স্টেশনে হামলা চালানো হয়। লুট করা হয় পুলিশের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য সরঞ্জাম। জাতীয় নির্বাচনে পেশিশক্তি প্রদর্শনের জন্য এসব অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে। তাই নির্বাচনের আগে এসব অস্ত্র উদ্ধার না করলে জননিরাপত্তা ঝুঁকিতে থেকেই যায়। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, হাতবদল হয়ে পুলিশের লুট হওয়া এসব অস্ত্র আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, দাগী অপরাধী, চরমপন্থী, স্থানীয় সন্ত্রাসী, জেলপালানো আসামি, পেশাদার অপরাধী এমনকি রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের হাতেও চলে গেছে। লুট হওয়ার পর বিভিন্ন সময় এসব অস্ত্র ব্যবহার করে খুনোখুনি থেকে শুরু করে নানাধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটছে।
জানা যায়, আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরাপদ করতে দেড় লাখের বেশি পুলিশকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসছে সরকার। জাতীয় নির্বাচনে নিরাপত্তার দায়িত্বে মাঠে থাকবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৮ লাখ সদস্য। পুলিশের জন্য থাকবে ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেবে, প্রতিদিন দেশে গড়ে খুন হচ্ছেন ১১ জন। থেমে নেই ছিনতাই-ডাকাতি। এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছেন পুলিশ প্রধান নিজেই।
সম্প্রতি পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, “একটা ট্রমাটিক এক্সপেরিয়েন্সের পরে ফোর্সটাকে আরও গুছিয়ে, তাদের শতভাগ কার্যকর করাই আমাদের জন্য জরুরি। এই জায়গায় কিন্তু আমি এখনও সন্তুষ্ট না, আপনারা যাই বলেন।”
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, আগামী নতুন বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাহিনীগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও খুব একটা বদলায়নি চিত্র। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি প্রকাশ্যে হামলার শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণির মানুষ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এক বছরে আইনশৃঙ্খলায় দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। বরং নির্বাচন ঘিরে দেশে নতুন করে সহিংসতা বাড়তে পারে। তাদের মতে, বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে—এ সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানিয়েছে, গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত ১১ মাসে সারা দেশে ৪৭১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ১২১ জন এবং আহত হয়েছেন ৫ হাজার ১৮৯ জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, “সার্বিকভাবে পরিস্থিতি আমার কাছে এখনও অনুকূল মনে হচ্ছে না। এর সাম্প্রতিক প্রমাণ হচ্ছে তুহিন নামের সাংবাদিককে হত্যা। এই যে চাঁদাবাজি—বিভিন্ন স্তরে চাঁদাবাজির প্রবণতা প্রমাণ করে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও দুর্বল।”
মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী এলিনা খান বলেন, “দেশের আইনশৃঙ্খলা খুব ভালো যাচ্ছিল, আমি বলব না। ৫ আগস্টের পর থেকে নাজুক অবস্থাতেই আছে। এটা থেকে উত্তরণের কোনো কার্যকর উদ্যোগও চোখে পড়ছে না।”
সচিবালয়ে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময় অনুযায়ী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। তিনি বলেন, “নির্বাচনের প্রস্তুতি যেভাবে নেওয়া দরকার আমরা সেভাবেই নিচ্ছি। ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন করতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। প্রধান উপদেষ্টা যে তারিখ বলে দিয়েছেন, আমরা ওইভাবেই নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত। আমরা সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত।”
অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে তিনি বলেন, “শুধু নির্বাচন উপলক্ষে নয়, দেশে অন্য সময়ও যেন কোনো ধরনের অস্ত্র ঢুকতে না পারে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অস্ত্র উদ্ধার একটা চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিনিয়ত অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে। নির্বাচনের আগে আমরা আশা করছি প্রায় সব অস্ত্র উদ্ধার করতে পারব।”
ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠ প্রশাসনকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া জননিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। সর্বোপরি, জাতীয় নির্বাচনের আগেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে জোর দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে, সেটিও দূর করতে হবে।
নির্বাচনের সময় বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্র ঢোকার প্রবণতা আগেও দেখা গেছে। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে এই ধরনের প্রবণতা ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “সীমান্ত নিরাপদ এবং সুরক্ষিত। আমাদের জনগণও সচেতন। সীমান্ত কতটা নিরাপদ? আপনারা দেখছেন, আমাদের সীমান্ত সম্পূর্ণ নিরাপদ। বর্ডার বেল্টে আমাদের জনগণ খুব সচেতন।”
এ বিষয়ে এআইজি (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, “নির্বাচনের আগে ও চলাকালীন সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সবসময়ই শঙ্কা থাকে। এ বিষয় মাথায় রেখে পুলিশ সতর্ক আছে। পুলিশের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে এবং ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। ১ লাখ ৫০ হাজার পুলিশ সদস্যকে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।”
এমবি/এসআর