ভূষণছড়া গণহত্যা; ৪৫০ বাঙালি হত্যার বিচার হয়নি ৩৭ বছরেও

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলার ভূষণছড়া গ্রাম। ১৯৮৪ সালের এই দিনে দুর্গম পাহাড়ি জনপদে নৃশংস এক গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এর জন্য দায়ী করা হয় জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সশস্ত্র শাখা শান্তি বাহিনীকে।
গ্রামবাসী ও নিরাপত্তা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, শান্তি বাহিনীর তৎকালীন সামরিক শাখার প্রধান মেজর রাজেশ ওরফে মনি স্বপন দেওয়ানের নেতৃত্বে ১২৫ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ গভীর রাতে পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে। ভোর ৪টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত মাত্র চার ঘণ্টার মধ্যে নারী-শিশুসহ সাড়ে চারশ নিরীহ বাঙালিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ফিরে যায় তারা। এ ঘটনায় আহত হয় সহস্রাধিক বাঙালি। ঘুমের মধ্যেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় শতাধিক পরিবার। স্থানীয় বিভিন্ন মহলের দাবি, ভূষণছড়া গণহত্যার ঘটনা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে বর্বরতম হত্যাকাণ্ড। কিন্তু সরকারি সেন্সরশিপের কারণে সেই সময় দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় এই ঘটনার কোনো রিপোর্ট হয়নি। বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি অশান্ত হতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে তৎকালীন সরকার গণহত্যার সংবাদ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
৩৭ বছর আগে গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে প্রতি বছর ৩০ ও ৩১ মে নানা কর্মসূচি আয়োজন করেন ভূষণছড়া গ্রামবাসী। এ উপলক্ষ্যে গতকাল রবিবার ভূষণছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে শোক ও আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা গণহত্যায় নেতৃত্বদানের অভিযোগে মেজর রাজেশের বিচার ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসন দাবি করে বলেন, গণহত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি পার্বত্য শান্তিচুক্তির আওতায় সাধারণ ক্ষমা লাভ করেন এবং পরবর্তী সময়ে বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একপর্যায়ে বিএনপি সরকারের প্রতিমন্ত্রীও হয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি নিধনের জন্য ভূষণছড়া গণহত্যাসহ সব হত্যার বিচার দাবি করে তারা বলেন, এ ক্ষেত্রে পার্বত্য শান্তিচুক্তি আইনগত বা সাংবাধিনকভাবে কোনো বাধা হতে পারে না। কারণ, শান্তিচুক্তিতে শান্তি বাহিনীকে ফৌজদারি অপরাধের জন্য দায়মুক্তি দেওয়া হয়নি।
অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসা ভুক্তভোগী পরিবারের কয়েক জনের সঙ্গে ইত্তেফাকের এ প্রতিবেদকের কথা হয়। গণহত্যায় নিজের ১২ জন আত্মীয়কে হারিয়েছেন এমন দাবি করে আব্দুল হাই নামে এক বৃদ্ধ ইত্তেফাককে বলেন, ভূষণছড়া হত্যাকাণ্ডের পর শান্তিবাহিনীর যেসব সন্ত্রাসী ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল সরকার তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে জমি, রেশন, ঘরবাড়ি, চাকরি ও ব্যাংকঋণ দিয়ে নানাভাবে পুনর্বাসিত করেছে। কিন্তু আমরা হতাহত পরিবারগুলো আজ পর্যন্ত কিছু পাইনি। নিহতদের লাশ যে গণকবরে দাফন করা হয়েছিল সেই গণকবরও যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তত্কালীন ভিডিপি কমান্ডার আব্দুল হামিদ বলেন, সেদিন ঘটনার পর গ্রামের মানুষ মামলা করতে বরকল থানায় গিয়েছিল। কিন্তু মামলা না নিয়ে জিডি নিয়েছিল। প্রশাসন আমাদের দুই একর করে জমিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মামলা না করতে বলেছিল। কিন্তু তারা আজ পর্যন্ত কোনো কথা রাখেনি। তাসলিমা নামে এক নারী তার পায়ে গুলির আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে বলেন, যারা সেদিন আক্রমণ-নির্যাতন করেছিল তারাই পরে সরকারি নানারকম সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। আমরা যারা মার খেয়েছিলাম তারাই এখন অনাহারে-অর্ধাহারে কষ্টে দিন কাটাচ্ছি।
ভূষণছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. মামুনুর রশিদ মামুন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দা বাঙালিদের নিধনে ভূষণছড়া গণহত্যাসহ এ পর্যন্ত যতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বর্তমান সরকারের কাছে তার বিচার দাবি করছি এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসন দাবি করছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুয়েল রানা বলেন, ১৯৮৪ সালে ভূষণছড়ায় সহিংস ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, সরকারের নির্দেশনা পেলে তাদের তালিকা প্রস্তুত করে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এমবি/এসআর