‘১০০ বছরেও যে গ্রামে ঢোকেনি পুলিশ’

মেঘনাবার্তা প্রতিনিধিঃ
রূপকথা নয়, বাস্তবের এক অনন্য দৃষ্টান্ত নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রাম। শিক্ষায় শতভাগ অগ্রগতি, নেই মাদক, নেই পারিবারিক নির্যাতন কিংবা বাল্যবিয়ে—এমনই একটি আদর্শ গ্রাম হিসেবে হুলহুলিয়া এখন সারা দেশে পরিচিতি পেয়েছে। গ্রামবাসীর দাবি, গত ১০০ বছরে কোনো মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে পুলিশকে তাদের গ্রামে ঢুকতে হয়নি।

শতভাগ শিক্ষিত জনপদ
প্রায় ৬ হাজার মানুষের এ গ্রামে সব ছেলে-মেয়ের জন্য এসএসসি পাস বাধ্যতামূলক। দারিদ্র্যের কারণে কেউ পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়লে ‘দরিদ্র তহবিল কমিটি’ তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয়। এই গ্রাম থেকেই বের হয়েছেন দুই শতাধিক প্রকৌশলী, শতাধিক এমবিবিএস ডাক্তার, ১৭ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ১১ জন বিচারকসহ অসংখ্য গুণী ব্যক্তি।

নিজস্ব সংবিধান ও বিচারব্যবস্থা
গ্রামটি পরিচালিত হয় ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’-এর নিজস্ব সংবিধান অনুযায়ী। পরিবারে সমস্যা দেখা দিলে প্রথমে পরিবার, এরপর পাড়ার কমিটি, এরপর সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ বিষয়টি মীমাংসা করে। তাই আদালত বা পুলিশের প্রয়োজন হয় না।

১৯৪০ সালে মছির উদ্দিন মৃধার উদ্যোগে পরিষদটি গঠিত হয়। গ্রামের আটটি পাড়ায় রয়েছে পৃথক ‘নিম্ন আদালত’। পরিষদের চেয়ারম্যান–ভাইস চেয়ারম্যানসহ মোট ২১ সদস্যের কমিটি দুই বছর পরপর ভোটে নির্বাচিত হন।

উন্নয়ন ও সহায়তার সংস্কৃতি
গ্রামে একটি মসজিদ, একটি গোরস্থান—বিভক্তি এড়াতে দ্বিতীয়টি নির্মাণ করা নিষিদ্ধ। দরিদ্র মানুষের ঘর মেরামত, অসহায় ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখা, বেকারদের সহায়তায় কাজ করে ‘শেকড়’ ও ‘বটবৃক্ষ’ নামের সংগঠন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত প্রায় ৪ হাজার প্রবাসী গ্রামবাসীও অর্থনৈতিক সহায়তা পাঠান।

ডিজিটাল গ্রামের রূপ
২০১৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় আধুনিক ‘ডিজিটাল হাব’। এতে রয়েছে কম্পিউটার ল্যাব, প্রজেক্টর, লাইভ টিভি ও ডিজিটাল ইসিজি রুম। হুলহুলিয়ার নিজস্ব ওয়েবসাইটও আছে।

গ্রামের গর্বিত সন্তানদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মোহাম্মদ হানিফ উদ্দিন মিয়া, সাবেক সচিব একে কাদের তালুকদার, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মির্জা মনজুরুল কাদের জুয়েল, এবং বিদেশে কর্মরত বহু প্রখ্যাত চিকিৎসক–প্রকৌশলী।

প্রশাসনের স্বীকৃতি
সিংড়া থানার ওসি মমিনুজ্জামান জানান, হুলহুলিয়ায় অপরাধ নেই বললেই চলে; যে কোনো সমস্যা তারা নিজেরাই সমাধান করেন। সিংড়া ইউএনও মাজহারুল ইসলাম বলেন, হুলহুলিয়া দেশের আদর্শ গ্রামগুলোর একটি, যেখানে আত্মনির্ভরতা ও শিক্ষাই উন্নয়নের মূল শক্তি।

হুলহুলিয়া প্রমাণ করেছে—সমাজ একসঙ্গে এগোতে পারলে কোনো গ্রামই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে।

এমবি/টিআই