৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে ভোটের আমেজ, চলছে ভোট গ্রহণ

শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ ডাকসু নির্বাচনের এক দিন বাদে ঢাকার অদূরে সাভারের জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসের জাকসু ভোটের দিকেই এখন সবার নজর।

Sep 11, 2025 - 13:07
 0  2
৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে ভোটের আমেজ, চলছে ভোট গ্রহণ
ছবি, সংগৃহিত

নিজস্ব প্রতিবেদক: কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নতুন নেতৃত্ব বেছে নিতে ৩৩ বছর পর ভোট চলছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও ভবনের ২১টি ভোটকেন্দ্রে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার কিছুক্ষণ পর শুরু হয়েছে ভোটগ্রহণ। প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী বিকাল ৫টা পর্যন্ত তাদের রায় জানানোর সুযোগ পাবেন।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদের নির্বাচন এমনিতেই বাড়তি মনোযোগ পাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ ডাকসু নির্বাচনের এক দিন বাদে ঢাকার অদূরে সাভারের জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসের জাকসু ভোটের দিকেই এখন সবার নজর।

নির্বাচন কমিশন বলছে, সুষ্ঠু ও নিরপক্ষেভাবে ভোটগ্রহণের জন্য সব প্রস্তুতিই তারা নিয়েছে। সব মিলিয়ে জাহাঙ্গীরনগরে উৎসবমুখর পরিবেশেই ভোট হবে বলে কর্তৃপক্ষ আশা করছে।

প্রার্থীরাও সবাইকে কেন্দ্রে এসে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কেউ কেউ নিরাপত্তা নিয়েও খানিকটা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

কেন্দ্রীয় সংসদের ২৫টি পদে লড়ছেন ১৭৭ জন প্রার্থী। হল সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৪৫ জন।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, মঙ্গলবার প্রশাসনিকভাবে পরীক্ষা বন্ধ ছিল, সেদিন ক্লাস খোলা থাকলেও অধিকাংশ বিভাগেই ক্লাস হয়নি। বুধবার ক্লাস ও পরীক্ষা দুটোই বন্ধ। বৃহস্পতিবার ভোট; শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। সব মিলিয়ে পাঁচ দিনের ছুটিতে পূর্ণ আবাসিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী হল ছেড়ে গেছেন।

অপরদিকে ছাত্রীদের ১০টি হলে মোট পদের সংখ্যা ১৫০টি। এর মধ্যে মাত্র ৩৮টি পদে সরাসরি ভোট হচ্ছে। বাকি পদগুলোতে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন বা ফাঁকা রয়েছে। ফলে অনেকেই নিরুৎসাহ বোধ করতে পারেন। এসব বিষয় ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব রাখতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।

জাকসুর ভোটার জামিন হায়দার মনে করেন, ৬০ শতাংশের মত ভোট পড়তে পারে।

তার যুক্তি, “প্রথমে ভাবছিলাম, ৫৫ শতাংশ ভোট পড়বে। তবে ডাকসু নির্বাচনের আমেজের কারণে ভোটের পরিমাণ কিছুটা বাড়তে পারে।”

বুধবার সকাল থেকেই ক্যাম্পাসজুড়ে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা চোখে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সড়কগুলোতে টহল দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম বলেন, “নতুন বাংলাদেশে প্রথমবারের মত ভোট দিতে যাচ্ছি। যে প্রার্থীই নির্বাচিত হন, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।”

নিরাপত্তা জোরদার ও নির্বাচনকে ঘিরে সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে আশাবাদী প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান।

তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলায় প্রায় ১২০০ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন উপহার দিতে চাই।”

কার কী প্যানেল

‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ প্যানেলে আব্দুর রশিদ জিতু ভিপি এবং মো. শাকিল আলীর জিএস পদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

ছাত্রদল লড়ছে শেখ সাদী হাসান এবং তানজিলা হোসেন বৈশাখীর নেতৃত্বে।

ইসলামী ছাত্রশিবির ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ নামে লড়বে। তাদের ভিপি প্রার্থী আরিফুল্লাহ আদিব এবং জিএস মাজহারুল ইসলাম।

বাগাছাসের ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ লড়বে আরিফুজ্জামান উজ্জ্বল এবং আবু তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়ামের নেতৃত্বে।

‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলে জিএস পদে শরণ এহসান, এজিএস (পুরুষ) পদে নুর এ তামীম স্রোত এবং এজিএস (নারী) পদে ফারিয়া জামান নিকি লড়বেন। এই প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী অমর্ত্য রায় জনের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে।

ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রফ্রন্টের ‘সংশপ্তক পর্যদে’ জিএস পদে জাহিদুল ইসলাম ঈমন, এজিএস-নারী পদে সোহাগী সামিয়া জান্নাতুল ফেরদৌস লড়াই করছেন।

জাকসুর মোট প্রার্থীর ২৫ শতাংশ ছাত্রী, বাকি ৭৫ শতাংশই ছাত্র। ভিপি পদে কোনো নারী শিক্ষার্থী প্রার্থী হননি। জিএস পদে ১৫ জনের প্রার্থীর মধ্যে মেয়ে দুইজন। আর চারটি পদে কোনো মেয়ে প্রার্থীই নেই।

সবগুলো হল সংসদ মিলিয়ে মোট প্রার্থীর ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ ছাত্রী। আর মেয়েদের হলগুলোর পাঁচটিতে ১৫ পদে প্রার্থীই নেই।

জাকসুর প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭২ সালে। সবশেষ নবম জাকসু নির্বাচন হয় ১৯৯২ সালের ৬ জুলাই।

প্রার্থীদের দাবি ও শঙ্কা

প্রত্যেক প্যানেলের প্রার্থীরা ভোটের আগের দিন বুধবার নিজেদের দাবি, আশঙ্কা এবং প্রতিশ্রুতি জানাতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। আনলাইনে প্রচার ছিল চোখে পড়ার মত।

ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম তিন দফা দাবির কথা জানিয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে- ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট নিয়োগ, ওএমআর মেশিন ক্রস চেক এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ।

মাজহারুল ইসলাম বলেন, “আমরা আশা করছি, শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে আসবেন এবং সৎ, যোগ্য প্রার্থী বেছে নেবেন।”

ছাত্রদল মনোনীত ভিপি প্রার্থী শেখ সাদী হাসান সাংগঠনিক কাজের ব্যস্ততার মাঝেও নিরাপত্তা জোরদারের দাবি জানান। তিনি বলেন, “আমরা চাই প্রশাসন পোলিং এজেন্ট নিয়োগ ও নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করুক।”

স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, “প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু গাফিলতি আছে। তবে আমরা আশাবাদী, জয় আমাদেরই হবে।”

হল সংসদের প্রার্থী আব্দুল হাদী ভোটের স্বচ্ছতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “বাইরে থেকে অনুপ্রবেশ না হলে ভেতরে ঝামেলা হবে না। তবে অতিরিক্ত ব্যালট ছাপানো হয়েছে বলে শুনেছি, যা উদ্বেগজনক। ভোট গণনা সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে।”

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (এজিএস নারী) প্রার্থী সোহাগী সামিয়া নিরাপত্তার ভিন্ন রূপরেখা তুলে ধরে বলেন, “আমরা চাই, পুলিশ ক্যাম্পাসের বাইরে থাকুক, কেবল প্রয়োজন হলে ভেতরে আসুক। আমরা ব্রেইল সিস্টেমে তিন ঘণ্টায় ইশতেহার ছেপেছি, তাহলে প্রশাসন কেন দ্রুত প্রস্তুতি নিতে পারবে না? অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন চাই, যেন ডাকসুর মতো কারচুপি এখানে না ঘটে।”

ডোপ টেস্ট নিয়ে প্রশ্ন

ভোটের আগ মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট।

ছাত্রফ্রন্ট (মার্কসবাদী) মনোনীত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (পুরুষ) প্রার্থী সজীব আহমেদ জেনিচ বলেন, “নির্বাচনের একদিন আগে ডোপ টেস্ট করা হয়েছে। যাদের ফল পজিটিভ আসবে, তাদের নাম কি ব্যালটে থাকবে? ভুল রিপোর্ট এলে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ নেই। অনেকেই বার্তা না পাওয়ায় নমুনা দিতে পারেননি, তাদের বিষয়ে কমিশনের অবস্থানও স্পষ্ট নয়। আমার কাছে ডোপ টেস্ট পুরো প্রক্রিয়াটাই নাটক মনে হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “পোলিং এজেন্ট রাখার অনুমতি নেই, তাহলে ভোট কারচুপি ঠেকানো যাবে কীভাবে? প্রশাসন বহিরাগত ঠেকাতেও ব্যর্থ। বিদ্যুৎ চলে গেলে ভোটকেন্দ্র মনিটরিং বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত।”

ডোপ টেস্ট প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, “ফলাফল এখনো হাতে পাইনি। যারা টেস্ট করায়নি, তাদের বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।”

ভোটের নিরাপত্তার চিত্র

জাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব রাশিদুল আলম বলেন, “নিরাপত্তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ফটক বন্ধ থাকবে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ভোটার, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও অনুমতিপ্রাপ্ত গণমাধ্যম কর্মী ও পর্যবেক্ষকরা (যাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমতিপত্র থাকবে) প্রবেশ করতে পারবেন।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে এ দিন পার্শ্ববর্তী এলাকার বহিরাগতদের চলাফেরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে; যা ভোটের পর দিন বেলা ১২টা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে জানান তিনি।

নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভোট গণনা ও ভোট কেন্দ্রগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচন কমিশন কার্যালয় থেকে বড় স্ক্রিনে সরাসরি মনিটরিং করা হবে বলেও জানান রাশিদুল আলম।

জাকসু নির্বাচনে ২১টি হলে ভোটকেন্দ্র থাকবে। এতে ২১ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং ৬৭ জন পোলিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন।

এ ছাড়া জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি টিম, প্রক্টরিয়াল বডি এবং ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা পুরো ক্যাম্পাসে দায়িত্ব পালন করবেন। দুজন ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে থাকবেন।

ওএমআর ব্যালট পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ করা হবে। জাকসুর জন্য তিন পৃষ্ঠার, দুটি হলের জন্য দুই পৃষ্ঠার এবং বাকি হলগুলোর জন্য এক পাতার ব্যালট পেপার ছাপানো হবে। ভোটাররা মোট ২২৪টি বুথে ভোট দেবেন।

ভোটার তথ্য

জাকসুতে এবার মোট ভোটার ১১,৮৪৩ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৬১১৫, ছাত্রী ৫৭২৮। একজন ভোটার ভোট দেবেন ৪০টি করে; কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫টি, হল সংসদে ১৫টি পদে।

এবার জাকসু ভোটের মোট প্রার্থী ১৭৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে পুরুষ প্রার্থী ১৩২ জন, নারী প্রার্থী ৪৬ জন। এখানে পদের সংখ্যা ২৫টি।

মোট ২১টি হল সংসদে পদের সংখ্যা ৩১৫টি। প্রতি হলে পদ সংখ্যা ১৫টি। মোট ৪৪৭ জন প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে ১১ ছাত্র হলের প্রার্থী সংখ্যা ৩১৬ জন এবং ১০ ছাত্রী হলের প্রার্থী সংখ্যা ১৩১ জন।

এমবি এইচআর